ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে আমরা জানতে পারলাম যে সুপ্রিম কোর্টে যত মামলা বিচারাধীন, তার ৮০ শতাংশেই সরকার একটি পক্ষ। মামলায় কোনো পক্ষই হারতে চায় না, সবাই জিততে চায়। সুতরাং সরকারও যে ওসব মামলায় জিততে চাইবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সরকার যদি বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে কারও পক্ষে কোনো ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ কি আর খোলা থাকবে ? তা সে হোক জমি অধিগ্রহণে আইন না মেনে কাউকে বাস্তুচ্যুত করা কিংবা বেআইনি আটকাদেশ অথবা নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির মতো কোনো গুরুতর প্রশ্ন।
সরকারদলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় নিজেদের দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন সাত হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে খুনের মামলাও রয়েছে।
প্রধান বিচারপতির কঠোর সমালোচনায় সরব হয়েছেন।অনেকে । তাঁদের কেউ কেউ বিচারপতিদের সম্পর্কে এমন সব মন্তব্য করেছেন, যা সংবাদপত্রে ছাপালেও তা আদালত অবমাননার দোষে দুষ্ট হওয়ার কথা। সংসদের ভেতরে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সাংসদদের দায়মুক্তি থাকলেও সংসদের বাইরে এমন মন্তব্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও নজিরবিহীন।
বিপরীতে সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপি এই রায়ে অনেকটাই উচ্ছ্বসিত। তারা বর্তমান সরকারের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা এই রায়ে খর্ব হয়েছে বলে দাবি করেছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এসব রাজনৈতিক বিতর্কে আদালতও কিছুটা বিব্রত। রায়ের বিরুদ্ধে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হকের অপ্রত্যাশিত সমালোচনায় ক্ষুব্ধ বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ নিয়ে প্রধান বিচারপতির এজলাসে হাজির হন। বিব্রত প্রধান বিচারপতি স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে আদালত রাজনীতির ফাঁদে পা দেবে না।
দায়টা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ওপরই বেশি পড়েছে। সুতরাং সবকিছুই যে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে গেছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। সামরিক শাসনের আমল দুটোকে ‘ব্যানানা রিপাবলিকের’ সঙ্গে তুলনায় আওয়ামী লীগের দ্বিমত থাকার কথা নয়। একইভাবে, ওই অংশে বিএনপি বা জাতীয় পার্টির উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই।
আইন সবার জন্য সমান, এই ঘোষিত নীতি মেনে চলায় সরকার যে কতটা আন্তরিক, তার দৃষ্টান্তগুলো কল্পনা করুন। আমাদের মন্ত্রিসভার সেসব সদস্যের কথা নিশ্চয়ই সবার স্মরণে আছে, যাঁরা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও মন্ত্রিত্বের পদে এখনো বহাল আছেন। আমরা এখানে আরও স্মরণ করতে পারি যে সরকারদলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় নিজেদের দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন সাত হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে খুনের মামলাও রয়েছে। অতএব উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জিগিরের সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি যে কতটা ঠুনকো, তা বুঝতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিচার বিভাগ খুব বেশি স্বাধীনতা ভোগ করলে রাজনীতিকদের মাঝেমধ্যেই এসব বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। ৪৬ বছরেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগবিধি তৈরি না করে রাজনীতিকেরা যে সুবিধাটুকু পাওয়ার আশা জিইয়ে রেখেছেন, সেটা যে সব সময় মেলে না, তাতে তাঁরা ক্ষুব্ধ হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীনদের আশা ছিল, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতাটাও নিজেদের হাতে নিতে পারলে ভবিষ্যতে তাঁদের আর কোনো বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হবে না। সেটা সাংসদ বা মন্ত্রীদের নিয়েই হোক আর যে ৮০ শতাংশ মামলায় রাষ্ট্র জিততে চায়, সেগুলোর ক্ষেত্রেই হোক!
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে মোটামুটি মোটাদাগে যেসব বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মতামত পাওয়া গেছে (আদেশ নয়), সেগুলো হচ্ছে: ১. সংবিধান সুরক্ষার ভার সুপ্রিম কোর্টের হাতেই ন্যস্ত। ২. জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সংসদ নয়। ৩. দেশে ‘আমিত্ব’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সবকিছুর ব্যক্তিকরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ‘ভুয়া ও মেকি গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ৪. সংসদ একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ৫. রাজনীতি এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ৬. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদেরা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। ৭. ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান (ওয়াচডগ) নেই। ৮. নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। ৯. গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গ্রহণযোগ্য সংসদ প্রতিষ্ঠা হয় না। ১০. সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা মানেনি। (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত [ত্রয়োদশ সংশোধনী] বাতিলের রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আরও দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার কথা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যাতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অংশগ্রহণের সুযোগ বাদ দেওয়ার কথা ছিল)। ১১. রাষ্ট্রক্ষমতা সাম্প্রতিক সময়ে গুটিকয়েক মানুষের একচ্ছত্র বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ১২. সামরিক শাসকেরা ক্ষমতার দখলদার এবং তাঁরা দুবার দেশে সামরিক-ব্যবসায়ী-অভিজাত শ্রেণির যোগসাজশের শাসনব্যবস্থা (ব্যানানা রিপাবলিক) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৩. চতুর্থ সংশোধনী ছিল সংবিধান পরিপন্থী এবং তার মাধ্যমেই বিচার বিভাগের জবাবদিহি রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়। ১৪. পঞ্চম সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার বিধান অপেক্ষাকৃতভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। ১৫. সামরিক শাসনের কণামাত্রও সংবিধানে না রাখার দাবি অসাড়। কেননা, রাষ্ট্রধর্ম, সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, জাতীয়তার পরিচয় বাংলাদেশি এবং মুসলিম পারিবারিক আইনের বিষয়গুলোতে সরকার হাত দেয়নি।
আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এখন বলছেন যে আদালতের পর্যবেক্ষণের আলোকে ৭০ অনুচ্ছেদের মতো অধিকার ক্ষুণ্নকারী আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জের সুযোগ এসেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষার বিষয়টিতে রিভিউ পিটিশন করার সম্ভাবনার কথাও সংবাদপত্রের পাতায় আলোচিত হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি এসব বিষয় নিষ্পত্তির জন্য আদালতমুখী হয়ে থাকব, নাকি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার কথা ভাবব? ষোড়শ সংশোধনীর রায় রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা খুব শক্তভাবে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এখন সেই সংস্কারের আলোচনা যত দ্রুত শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment
পাঠকের মন্তব্য আবশ্যক