সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একযোগে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী ছিল সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমান নয়, বরং চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারাই সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করে বিচারক অপসারণের কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল। আর সেই ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য হুমকি বিবেচনা করে এবং তার তুলনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে ‘অধিকতর স্বচ্ছ’ পদ্ধতি বিবেচনায় আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীর মামলার রিভিউতে তা মার্জনা করেছিলেন। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার যে পূর্ণাঙ্গ রায় মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতিই এই পর্যবেক্ষণে একমত পোষণ করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে গৃহীত চতূর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় (বাকশাল) শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
রায়ে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকার সুচিন্তিতভাবে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি সংবিধানে রেখে দেয় এবং অন্য অনেক বিধানের মতোই ৯৬ অনুচ্ছেদকেও সংবিধানের অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো হিসেবে ঘোষণা করে। তাই জিয়ার সামরিক ফরমান নয়, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণের লক্ষ্যে প্রণীত ষোড়শ সংশোধনীটি ছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিপন্থী।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া লিখেছেন, সংসদ সদস্যদের নজরে এটাও আনা হয়নি যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অভিসংশনের ক্ষমতা রহিত করেছিলেন। তিনি ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করেছিলেন।
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন লিখেছেন, চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারা বিচারক অপসারণের প্রক্রিয়া মৌলিকভাবে পরিবর্তিত (মেটারিয়ালি এফেক্টেড) হয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ না হওয়ার কারণে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে একটি বৈধ সংবিধানের অংশ হিসেবে তা থেকে গিয়েছিল। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মনে করেন, চতুর্থ সংশোধনীর চেয়ে পঞ্চম সংশোধনী ‘অধিকতর স্বচ্ছ’ বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা মার্জনা করেছিলেন। আর সেই মার্জনাসংক্রান্ত রায় সংবিধানের ১১১ ও ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। তাই ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের লঙ্ঘন ঘটেছে।
বিচারপতি মো. ইমান আলী লিখেছেন, ৯৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে বলা যায়, ’৭২-এর সংবিধান ’৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংশোধিত অবস্থায় ছিল। সে সংশোধনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদ কর্তৃক তৈরি করা হয়েছিল। আর ঘটনাক্রমে সেই সংসদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিচারপতি ইমান আলী লিখেছেন, সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে স্পষ্টতই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছিল। এটা কৌতূহলপূর্ণ যে, ’৭২-এ সংবিধানে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিতেন। অথচ চতুর্থ সংশোধনীতে বিধান করা হলো, রাষ্ট্রপতি স্পিকারের কাছে শপথ নেবেন। এরপর সামরিক ফরমান দ্বারা পুনরায় বিধান করা হয় যে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির কাছেই শপথ নেবেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার শপথ নেওয়ার বিধান স্পিকারের কাছেই ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এর মানে, ’৭২-এর সংবিধানে নয়, তারা ফিরে গেছে চতুর্থ সংশোধনীতে। সুতরাং সংসদের উদ্দেশ্য যদি ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়, তাহলে প্রধান বিচারপতিরই উচিত রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়ানো।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তাঁর রায়ে সামরিক ফরমানগুলো অবিকল তুলে ধরে দেখিয়েছেন, এসব পরিবর্তন গোড়া থেকেই বাতিল বলে গণ্য। কিন্তু আপিল বিভাগ ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত তাকে মার্জনা করলেও তার ‘বাতিল’ চরিত্রের কোনো হেরফের ঘটেনি। এই পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদের প্রতিস্থাপন ঘটে। সুতরাং আগের বাতিল বিধানটি বৈধ সংশোধন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হামলা ১৯৮২ সালে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। তবে এখন সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গ।
বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার উল্লেখ করেছেন, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রপতির হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘আমি প্রধান বিচারপতির সব পর্যবেক্ষণ, মন্তব্যসহ তাঁর অভিমতের সঙ্গে একমত।’
পঞ্চদশ সংশোধনী ও সংসদের সামর্থ্য
রায়ে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, শুনানির সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী তাড়াহুড়ো করে পাস করা হয়েছিল, সাবেক আইনমন্ত্রী বিষয়টিতে নজর দেননি। আদালত ওই যুক্তি গ্রহণ করেননি। বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিযোগ দুর্ভাগ্যজনক। খুব ভালোভাবে আলাপ-আলোচনার পরই ওই বিধান রেখে পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতি ৮১টি সামরিক আইনকে সংসদে পাইকারি হারে গ্রহণ করার জন্য সংসদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ বিষয়ে শফিক আহমেদ বলেন, এটা সঠিক নয়, এখানে সংসদের সামর্থ্যের প্রশ্ন আসে না।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার রায় ও তাঁর যাবতীয় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তাঁর পরবর্তী ছয় বিচারকের মধ্যে তিনজনই শর্তহীন সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। বাকি তিনজনের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীও অধস্তন আদালতের ওপর রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ যেহেতু এই মামলার প্রতিপাদ্য নয়, তাই তাঁরা এ বিষয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। অপর বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ না করে পঞ্চম সংশোধনী মামলায় ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আপিল বিভাগের আশাবাদের পুনরুল্লেখ করেছেন।
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী জিয়াউর রহমান ও এরশাদের দুই সামরিক শাসনের সময়ে জারি করা ফরমান ও অধ্যাদেশগুলো নবম সংসদে অবিকল গ্রহণ করার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে এগুলো এই মামলার বিচার্য বিষয় নয়।
প্রধান বিচারপতি আরও লিখেছেন, ‘আমরা যদি ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ দেখি, তাহলে এটা নগ্নভাবে ফুটে উঠবে, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে তাদের কাজ করা উচিত সেভাবে করতে পারছে না। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের এক সিভিল রিভিউ পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রণীত অইনসমূহ ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাময়িকভাবে মার্জনা করেছিলেন। আদালতের আদেশে বলা হয়েছিল, সংসদ যাতে ওই সময়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে এবং আইনগুলোও তৈরি করতে পারে। অথচ সংসদ আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন কিংবা আদালতের নির্দেশনার তাৎপর্য অনুধাবন করা ছাড়াই ২০১৩ সালে ৬ নম্বর আইন তৈরি করেছে।’
প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, এর মাধ্যমে তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জারি করা কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকর করেছে। বিলে লেখা হয়েছিল, ‘এ সময়ের যত অধ্যাদেশ তা এখন থেকে এমনভাবে কার্যকর থাকবে, যেন তা সংসদের দ্বারা প্রণীত হয়েছে। তবে এভাবে তা গ্রহণ করা হয়েছে বলে তা কোনোভাবেই অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সামরিক শাসনে কৃত কর্মের সমর্থন করেছে বলে গণ্য হবে না।’ বিলের এই ভাষ্য তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, বিলের ওই বিবৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সংসদ আইন প্রণয়নের পরিবর্তে ৮১টি (সামরিক) আইনকে সমর্থন ও অনুমোদন দিয়েছে। একইভাবে তারা ২০১৩ সালের ৭ নম্বর আইনের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বরের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশগুলো আইনে পরিণত করেছে। সংসদে আনা বিলে তারা উল্লেখ করেছে, সামরিক শাসনে জারি করা এসব ‘আইনের শাসন ও জনস্বার্থে কার্যকর রাখা হলো।’ ২০১১ সালের ৪৮ নম্বর দেওয়ানি আপিলে আপিল বিভাগ সংসদকে বাতিল করে দেওয়া আইনগুলোকে নতুন করে তৈরি করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কারণ ওই আইনগুলো ক্ষমতা জবরদখলকারীরা প্রণয়ন করেছিল। এটা পরিহাস যে সংসদ তার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ অপারগতার পরিচয় দিয়েছে।
তিনি বলেন, অধিকাংশ আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে কয়েকটির সঙ্গে মৌলিক অধিকারের বিষয় জড়িত রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯৮২ সালের অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড রিকুইজেশন অব ইমমুভেবল প্রোপার্টি অর্ডিনেন্সের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সামরিক জবরদখলকারীদের তৈরি করা আইন যা সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছেন সেগুলো তাঁরা অনুসমর্থন করেছেন। অথচ বাংলাদেশ সংবিধান সংসদকে এভাবে আইন গ্রহণ করতে কোনো এখতিয়ার দেয়নি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আদালতে বসে এসব আইনের আওতায় বিচারকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে বিব্রত বোধ করতে হয়। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন লাভের আগে তাঁদের বোঝা উচিত সংবিধান নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করা তাঁদের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷