|
www.bdnewstracker.blogspot.com
|
‘অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোকে জীবনেরই অংশ মেনে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা ধারণ করলে, নিজেকে ভালোবাসলে, জীবনকে ভালোবাসলে বিষণ্নতা আমাদের নাগাল পায় না
যা পেয়েছি আমি তা চাই না, যা চেয়েছি কেন তা পাই না।’ সবকিছু আমাদের মনের মতো হয় না। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে ফারাক থাকে। স্বপ্ন ভেঙে যায়। পরীক্ষার ফল সব সময় আশানুরূপ হয় না, চাকরিতে আসে না প্রত্যাশিত সাফল্য। প্রিয়জনের সঙ্গে মেলে না সব চাওয়া। আমরা হতাশ হই, ধূসর বিষণ্ন লাগে চারপাশ। আবার কখনো কেন যে বুকটা হু হু করে...কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়! অপ্রাপ্তিকে মেনে নিই, কখনো নতুন নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। মেঘ কেটে গিয়ে ঝকঝকে রোদ ওঠে। কিন্তু এমন সময়ও আসে, যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়, মন আর ভালো হয় না। প্রতিদিনকার স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছা করে। নিজের অস্তিত্বকে অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন মনে হয়। ক্লান্তি, অবসাদ, অস্থিরতার বৃত্তে ঘুরপাক খায় দিন। আশপাশের মানুষগুলোর প্রতি বিরক্তি ঘনিয়ে ওঠে, তাদের সঙ্গ এড়িয়ে নিজের খোলসের ভেতর ঢুকে থাকতে ইচ্ছা করে। ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, হীনম্মন্যতা তীব্রভাবে জেঁকে বসে। নাছোড়বান্দা এই মন খারাপের নাম দেওয়া যায় বিষণ্নতা রোগ বা ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার।
কেন বিষাদ করে ভর
সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক, বংশগত বিভিন্ন কারণে মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ফারুক হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ তীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত। মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার প্রধান কারণও বিষণ্নতা। মূলত বায়োলজিক্যাল ও বায়োসাইকোসোশ্যাল কারণে বিষণ্নতা দেখা যায়। হরমোনজনিত ও বংশগত বিষণ্নতার পেছনে দায়ী বায়োলজিক্যাল বিন্যাস। শৈশবের কোনো ভয়ভীতি, দুর্ঘটনা বা তিক্ত অভিজ্ঞতা বিষণ্নতার মূলে থাকলে সেটাকে আমরা বায়োসাইকোসোশ্যাল কারণ বলতে পারি।’অন্তর্মুখী, সংবেদনশীল, অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তিদের বিষণ্নতায় ভোগার প্রবণতা বেশি। বিষাদ রোগে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষে বিভিন্ন ধরনের জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে এবং দুষ্টচক্রের মতো তা চলতেই থাকে। হরমোনের পরিবর্তনে, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতায়, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এমনকি ঋতু পরিবর্তনেও (যেমন তীব্র শীতে) বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। পুরুষের তুলনায় নারীরা বিষণ্নতায় বেশি ভোগেন। সন্তান জন্মের পরপর অনেক নারীই পোস্ট-পারটাম ব্লু নামের বিষণ্নতার কবলে পড়েন। মেনোপজের সময়ও নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার উপসর্গ দেখা যায়।বিষণ্নতার বিভিন্ন স্তরবিষণ্নতার একটা স্তরের সঙ্গে আরেকটা স্তরের উপসর্গে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। এদের আলাদা করা হয় তীব্রতার ভিত্তিতে।
হালকা বিষণ্নতাআত্মবিশ্বাস কমে যায়। সবকিছুর প্রতি অনীহা, উদ্যমহীনতা দেখা দেয়। ভালো লাগার কাজগুলোর প্রতিও উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। তবে এ স্তরে চিন্তাভাবনার যৌক্তিকতা ব্যাহত হয় না।
মাঝারি বিষণ্নতাহতাশা তীব্র হয়। হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। চিন্তার গতি ধীর হয়ে যায়, গভীরভাবে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে যায়। বিষাদাক্রান্ত ব্যক্তি অপরাধবোধে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেন, নিজেকে অকারণে দোষারোপ করতে থাকেন। বিষণ্নতা জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। খিদে কমে যায়, ঘুমাতে কষ্ট হয়।
তীব্র বিষণ্নতা
মাঝারি বিষণ্নতার লক্ষণগুলো এ পর্যায়ে এসে তীব্র আকার ধারণ করে। জীবন পুরোপুরি বিষণ্নতার দখলে চলে যায়। বিষাদাক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই কাঁদতে থাকেন। নিজের চেহারা, পোশাকের ব্যাপারে কোনো সচেতনতা কাজ করে না। স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা ব্যাহত হয়। চেনা পরিবেশেও খাপ খাওয়াতে পারেন না। জীবনবিমুখ ও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েন।
বিষণ্নতা থেকে মুক্তি
‘বিষাদাক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় নিজে বুঝতে পারেন না তিনি বিষণ্নতায় ভুগছেন কি না বা তাঁর বিষণ্নতা কোন পর্যায়ে আছে।’ জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ‘আমাদের সবারই উচিত খেয়াল করা আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের কেউ বিষণ্নতায় আক্রান্ত কি না। কেউ নিজের ভেতর বিষণ্নতার উপস্থিতি টের পেলে কারণটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। চিন্তা-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনুন। নেতিবাচক চিন্তাকে সরিয়ে ইতিবাচকভাবে দেখতে চেষ্টা করুন বিষয়টিকে। ভেতরে সব চেপে রেখে একা একা কষ্ট না পেয়ে কাছের বন্ধু, আত্মীয়স্বজনকে খুলে বলুন। যা করতে সচরাচর ভালো লাগে তা করুন।’
প্রয়োজনে সাইকোলজিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপির মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা আপনার বিষণ্নতা কাটাতে সাহায্য করতে পারেন। তাঁদের ওপর আস্থা রাখুন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।
রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টস থেকে প্রকাশিত বিষণ্নতা-বিষয়ক বইয়ে বলা হয়েছে, হালকা ব্যায়াম, শরীরের যত্ন, সুষম খাবার বিষণ্নতার তীব্রতা কমিয়ে দেয়। মদ্যপান দেয় বিষণ্নতা বাড়িয়ে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ধ্যানের চর্চা বিষণ্নতা দূর করতে দারুণ ভূমিকা পালন করে।
বিষণ্নতা জীবনেরই একটা ঋতু
জীবনে চলার পথ অনেক সময়ই হয়ে ওঠে অমসৃণ, এবড়োখেবড়ো। আমরা মুখ থুবড়ে পড়ি। কখনো পথের সাথিকে হারিয়ে ফেলি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোকে জীবনেরই অংশ মেনে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা ধারণ করলে, নিজেকে ভালোবাসলে, জীবনকে ভালোবাসলে বিষণ্নতা আমাদের নাগাল পায় না। আসলে ইতিবাচকতাই ডিপ্রেশন তাড়ানোর প্রধান অস্ত্র। সেই সঙ্গে প্রয়োজন এ বিষয়ে সচেতনতা। বিষণ্নতা আমাদের মানসিকভাবে পরিণত করে তোলে। বিষাদ কেটে গেলে আমরা দৃঢ়চেতা হয়ে উঠি। সমস্যা মোকাবিলায় পারদর্শী হই। কুয়াশা কেটে গিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠে স্বচ্ছ, পরিষ্কার।