সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় নিয়ে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে
যেসব অভিযোগ খাড়া করেছেন, তার অনেকটাই অসার প্রমাণিত হয়েছে প্রথম আলোয়
প্রকাশিত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ।
সুপ্রিম কোর্টের রায় ও প্রধান বিচারপতির
পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রধান অভিযোগ—এতে সামরিক শাসক প্রবর্তিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখা, সংবিধানে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা
করা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে খাটো করে দেখা হয়েছে। এই তিন
অভিযোগের প্রথমটি রায় এবং পরের দুটি শুধুই পর্যবেক্ষণ, তবে এ জন্য প্রধান বিচারপতিকে দোষারোপ করার ভিত্তি নেই। এর
কোনোটিই সত্য নয়।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল জিয়াউর রহমান করলেও এর উৎস চতুর্থ সংশোধনী। চতুর্থ সংশোধনীতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়ে যাওয়া হয়। জিয়াউর রহমান সেটি নিজের হাতে না রেখে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত করেন। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতেও তা টিকিয়ে রাখা হয়। মূল সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও বদলির কর্তৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাতে প্রত্যর্পণের কথা থাকলেও সরকার সেখানে ফিরে যেতে চায় না। অথচ সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফেরত নেওয়ার আইন করেছে।
বিস্ময়কর হলো আওয়ামী লীগ, জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনকে
অবৈধ দাবি করলেও সেই শাসনের এমন কিছু ধারা বহাল রেখেছে, যা বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আদি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্মের নামে কোনো দল বা সংগঠন করা যাবে না।
জেনারেল জিয়া সেটি বাতিল করে দেন এবং অদ্যাবধি তাঁর ফরমানই সংবিধানে বহাল আছে।
আমরা জাতি হিসেবে যে কতটা অদূরদর্শী ও
অবিবেচক ষোড়শ সংশোধনী রায় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করে সেটাই প্রমাণ করেছি।রায়ে আদালত
যদি কোনো ভুল করে থাকেন, আইনি পথেই তার প্রতিকার খোঁজা উচিত ছিল।
কিন্তু রাজপথে-মঞ্চে বিচার বিভাগকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কিংবা প্রধান
বিচারপতিকে গণ-আদালতে বিচার করার রণহুংকার দেওয়া কেবল সংবিধান লঙ্ঘন নয়, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারেরও পরিপন্থী।তিন সপ্তাহ ধরে
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে ভাষায় প্রধান বিচারপতিকে গালমন্দ করেছেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিকেরা সেটি করতে পারেন না
রায়ের পর্যবেক্ষণ যতটা আমরা পড়েছি, জেনেছি তাতে তিনি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানকে কটাক্ষ করে কিছু বলেছেন বলে মনে হয় না। বরং তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে
বহুবার বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করেছেন, দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য তাঁর
অসাধারণ অবদানকে স্বীকার করেছেন।
প্রধান বিচারপতি যে ‘আমিত্বের’ কথা বলেছেন, বা একক ব্যক্তি দ্বারা কোনো দেশ গঠিত হয় না বলে রায়ে যে
পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেটি কোনো ব্যক্তি বিশেষকে লক্ষ করে নয়; বরং আমাদের রাষ্ট্রীয়,
রাজনৈতিক
ও প্রাতিষ্ঠানিক একনায়কত্ববাদের কথা বলেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে জাতীয় সংসদে
আলোচনা হতে পারে, আইনি তর্কও চলতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই রায় নিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করা
গণতান্ত্রিক রীতির পরিচয় নয়। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে ষোড়শ সংশোধনীর
রায় ছাপিয়ে প্রধান বিচারপতির দেশপ্রেম, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি নিয়েও কটাক্ষ করা হয়েছে।
এখানে দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরছি: ২৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
সামনে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে আওয়ামী
লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন,
‘প্রধান
বিচারপতির বিচার জনতার আদালতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে জনতার আদালত তৈরি হচ্ছে।’ একই দিন বিএমএ আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে কৃষিমন্ত্রী
মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আপনার বাংলাদেশের কিছুই পছন্দ হয় না। আপনি
বাংলাদেশ ত্যাগ করলেই পারেন। আবোলতাবোল কথার কিন্তু একটা সীমা আছে।’ যুব মহিলা লীগের মানববন্ধনে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু
বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে)
সিনহা পাকিস্তানপ্রেম দেখান। কারণ, তিনি পাকিস্তানের দালাল।’ তবে আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত দুই মন্ত্রী-খাদ্যমন্ত্রী
কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তর্জন-গর্জনে
সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাংসদ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, একটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক রায় লিখে দিয়েছেন।
জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের কথা মেনে নিলে আওয়ামী লীগ
সরকার একজন পাকিস্তানপন্থী লোককে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’প্রধান বিচারপতি বানিয়েছে। তাও যোগ্যতা বিবেচনা করে নয়, সংখ্যালঘু হিসেবে অনুগ্রহ করে। তাঁদের জানা উচিত, বাংলাদেশের অনেক আগেই একজন হিন্দু পাকিস্তানের প্রধান
বিচারপতি হয়েছিলেন। কোনো পত্রিকার সম্পাদক রায় লিখে দিয়েছেন বা লেখা রায়
পেনড্রাইভে তাঁর কাছে চলে আসার কথা বলা কেবল ব্যক্তি নয়, গোটা বিচারব্যবস্থার প্রতিই অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। প্রধান
বিচারপতিকে পাকিস্তানে পাঠানো কিংবা জনতার আদালতে বিচার করার হুমকি নিশ্চয়ই
রাজনৈতিক সুরুচি বা শালীনতার পরিচয় নয়। যখন কোনো মন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছে, তাঁর মাধ্যমে পদায়ন পাওয়া ব্যক্তিকেই খাটো করা হয় না, নিয়োগকর্তা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও হেয় করা হয়। সে ক্ষেত্রে
তো প্রধান বিচারপতি সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে যে শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, সেটাই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।
যখনই দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতির কথা
আসে, আওয়ামী লীগ নেতারা বুলন্দ আওয়াজ তোলেন, স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় তাঁদের ভাষায় স্বাধীনতাবিরোধী
শক্তি দেশ শাসন করেছে বলেই এই দুর্গতি। তাহলে ৪৬ বছরের দায় কেন আওয়ামী লীগ নিজের
কাঁধে নিল এবং বিচার বিভাগকে শত্রুর কাতারে দাঁড় করাল?
রায়ে ক্ষমতাসীনেরা যদি সত্যি সত্যি আহত ও
ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তঁাদের উচিত রিভিউর জন্য আবেদন করে প্রতিকার
চাওয়া। আদালতকে রাজপথে নিয়ে আসা যেকোনোভাবেই কারও জন্য কল্যাণকর নয়, সে কথাটিই আরও পরিষ্কার করে বলেছেন .
প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
তিনি লিখেছেন, ‘এবারের বিতর্কে যদি বিচার বিভাগের
ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়, তাহলে নির্বাহী বিভাগের ক্রেডিবিলিটিও নষ্ট
হবে, তাহলে নির্বাহী বিভাগের ক্রেডিবিলিটিও রক্ষা
পাবে না। বিচার বিভাগের মর্যাদা যতটা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তা উদ্ধারে বহু যুগ লাগবে। আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী ও
নেতা লাগামহীন কথাবার্তা শুরু করেছেন, তাঁরা যেন সতর্ক হন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে
শূন্যাবস্থা সৃষ্টি করে তাঁরা যেন সেই শূন্যাবস্থা পূরণে একটি অপশক্তির পথ খুলে না
দেন। (আগুন নিয়ে খেলা, যুগান্তর, ২৮ আগস্ট ২০১৭)।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।